Hijab

পুরুষের মুখমন্ডল ঢাকা ফরজ না কেনো ইসলামের মতে?

ইসলামে নারীদের পর্দা (হিজাব) একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা শালীনতা, সম্মান এবং আত্মসংযমের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। পর্দার ধারণা কুরআন, হাদিস এবং ইসলামী ফিকহের আলোকে বিস্তৃতভাবে আলোচিত হয়েছে। নিচে নারীদের পর্দা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:


১. পর্দার সংজ্ঞা

পর্দা শুধু পোশাকের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি একটি ব্যাপক ধারণা যা নারীর আচরণ, দৃষ্টি, কথাবার্তা এবং পোশাকের শালীনতাকে অন্তর্ভুক্ত করে। পর্দার উদ্দেশ্য হলো নারীর সম্মান রক্ষা, অপ্রয়োজনীয় দৃষ্টি থেকে সুরক্ষা এবং সমাজে শান্তি ও নৈতিকতা বজায় রাখা।


২. কুরআনের নির্দেশনা

কুরআনে পর্দা সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি আয়াত রয়েছে:

  • সূরা নূর (২৪:৩১):
    এই আয়াতে নারীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যেন তারা তাদের দৃষ্টি নত রাখে, লজ্জাস্থান হেফাজত করে এবং তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। তাদের বলা হয়েছে, “তারা যেন তাদের মাথার ওড়না দিয়ে বক্ষদেশ ঢেকে রাখে এবং তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে, কেবল যা সাধারণত প্রকাশিত থাকে তা ব্যতীত।” এখানে হিজাবের ধারণা স্পষ্ট হয়, যা মাথা ও বুক ঢাকার উপর জোর দেয়।
  • সূরা আহযাব (৩৩:৫৯):
    এই আয়াতে বলা হয়েছে, “হে নবী! তোমার স্ত্রীদের, কন্যাদের এবং মুমিন নারীদের বলো, তারা যেন তাদের উপর বড় ওড়না টেনে দেয়। এটা তাদের জন্য অধিক উপযুক্ত, যাতে তারা চেনা যায় এবং তাদের কষ্ট দেওয়া না হয়।” এই আয়াতে জিলবাব (বড় চাদর বা বাইরের পোশাক) পরার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।


৩. হাদিসের নির্দেশনা

হাদিসে পর্দার বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা পাওয়া যায়:

  • হিজাবের গুরুত্ব: হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যে নারী বয়ঃসন্ধি লাভ করেছে, তার জন্য তার মুখ ও হাতের তালু ছাড়া অন্য কিছু প্রকাশ করা উচিত নয়।” (আবু দাউদ)
  • শালীন আচরণ: রাসূলুল্লাহ (সা.) নারীদের অপ্রয়োজনীয়ভাবে পুরুষদের সাথে মিশ্রিত হতে নিষেধ করেছেন এবং শালীন আচরণের উপর জোর দিয়েছেন।


৪. পর্দার উদ্দেশ্য

ইসলামে পর্দার কয়েকটি প্রধান উদ্দেশ্য রয়েছে:

  • শালীনতা ও সম্মান: পর্দা নারীর সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করে এবং অশোভন দৃষ্টি থেকে সুরক্ষা দেয়।
  • নৈতিকতা বজায় রাখা: পর্দা সমাজে অশ্লীলতা ও অনৈতিকতা প্রতিরোধে সহায়তা করে।
  • পরিচয় প্রকাশ: সূরা আহযাবের আয়াত অনুযায়ী, পর্দা মুসলিম নারীদের পরিচয় বহন করে এবং তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ প্রকাশ করে।
  • আত্মনিয়ন্ত্রণ: পর্দা নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্যই আত্মনিয়ন্ত্রণ ও শুদ্ধ চরিত্র গঠনে সহায়ক।


৫. পর্দার ধরন

পর্দা শুধু শারীরিক পোশাক নয়, এটি আচরণগত ও মানসিক দিকও অন্তর্ভুক্ত করে:

  • শারীরিক পর্দা (হিজাব/জিলবাব):
    • হিজাব: মাথার চুল, গলা এবং বুক ঢেকে রাখার জন্য ওড়না বা স্কার্ফ। এটি শরীরের আকৃতি প্রকাশ না করা এবং শালীন পোশাকের সাথে পরতে হয়।
    • জিলবাব: বাইরের পোশাক, যা পুরো শরীর ঢাকে এবং আলগা হয়, যাতে শরীরের গঠন প্রকাশ না পায়।
    • নিকাব: কিছু নারী মুখমণ্ডল ঢাকার জন্য নিকাব পরেন, যদিও এটি নিয়ে আলেমদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। হানাফি ও মালিকি মাযহাবে মুখ ঢাকা ফরজ নয়, তবে শাফিঈ ও হাম্বলি মাযহাবে এটি ফরজ বলে বিবেচিত হয়।
  • আচরণগত পর্দা:
    • দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ: নারীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে অপ্রয়োজনীয়ভাবে পুরুষদের দিকে তাকাতে নিষেধ করতে।
    • কথাবার্তা: কথায় নরম ভাষা এড়ানো, যাতে ভুল বোঝাবুঝি না হয় (সূরা আহযাব ৩৩:৩২)।
    • চলাফেরা: নারীদের শালীনভাবে চলাফেরা করতে বলা হয়েছে, যাতে অপ্রয়োজনীয় মনোযোগ আকর্ষণ না হয়।


৬. পর্দা নিয়ে মতভেদ

ইসলামী আলেমদের মধ্যে পর্দার কিছু দিক নিয়ে মতভেদ রয়েছে:

  • মুখ ও হাত ঢাকা: কিছু আলেম মনে করেন মুখ ও হাত ঢাকা ফরজ নয়, যদি ফিতনার আশঙ্কা না থাকে। অন্যরা বলেন, পূর্ণ পর্দার জন্য মুখ ঢাকা প্রয়োজন।
  • পোশাকের ধরন: হিজাব ও জিলবাবের নকশা ও রঙ নিয়ে স্থান ও সংস্কৃতি অনুযায়ী ভিন্নতা রয়েছে, তবে শর্ত হলো পোশাক শালীন ও আলগা হতে হবে।
  • স্থানভেদে পর্দা: কিছু আলেম মনে করেন, শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ পরিবেশে পর্দার কিছু শর্ত শিথিল হতে পারে, তবে মূলনীতি অপরিবর্তিত থাকে।


৭. সমসাময়িক প্রেক্ষাপট

আধুনিক যুগে পর্দা নিয়ে বিভিন্ন বিতর্ক দেখা দেয়। কিছু নারী হিজাবকে তাদের ধর্মীয় পরিচয়ের অংশ হিসেবে গ্রহণ করেন, আবার কেউ কেউ এটিকে সাংস্কৃতিক বা সামাজিক চাপ হিসেবে দেখেন। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে, পর্দা একটি স্বেচ্ছায় ইবাদত, যা নারীর ইচ্ছা ও বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে। তবে, এটি জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়, কারণ ইসলামে কোনো জবরদস্তি নেই (সূরা বাকারা ২:২৫৬)।


৮. পর্দার সীমা

পর্দা পালনের ক্ষেত্রে কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে:

  • মাহরাম পুরুষদের সামনে: নারীরা তাদের মাহরাম পুরুষদের (যেমন, বাবা, ভাই, স্বামী, ছেলে) সামনে পর্দা শিথিল করতে পারেন।
  • চিকিৎসা বা জরুরি প্রয়োজন: চিকিৎসা, সাক্ষ্যদান বা অন্যান্য জরুরি ক্ষেত্রে পর্দার কিছু শর্ত শিথিল হতে পারে।
  • নাবালেগ মেয়ে: বয়ঃসন্ধির আগে মেয়েদের জন্য পর্দা বাধ্যতামূলক নয়।


উপসংহার

ইসলামে নারীদের পর্দা শুধু বাহ্যিক পোশাক নয়, বরং এটি একটি জীবনধারা যা শালীনতা, আত্মমর্যাদা এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। কুরআন ও হাদিসের নির্দেশনা অনুযায়ী, পর্দা নারীদের জন্য একটি ফরজ ইবাদত, যা তাদের সম্মান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। তবে, এটি স্থান, সময় ও পরিস্থিতি অনুযায়ী কিছুটা ভিন্নভাবে পালিত হতে পারে। মূল বিষয় হলো নিয়ত ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Table of Contents

Translate »