image (1)

১৯৭২ সালের সংবিধানের অসঙ্গতি

১৯৭২ সালের বাংলাদেশের সংবিধান একটি ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়, যা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান হিসেবে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গৃহীত হয় এবং ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ থেকে কার্যকর হয়। এই সংবিধানে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতাকে মূল নীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। তবে, এই সংবিধানে কিছু অসঙ্গতি বা সমালোচনার বিষয় ছিল, যা সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচিত হয়েছে। নিচে ১৯৭২ সালের সংবিধানের অসঙ্গতিগুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো এবং কিছু প্রশ্নোত্তর দেওয়া হলো।


১৯৭২ সালের সংবিধানে কিছু অসঙ্গতি বা দুর্বলতা ছিল, যা নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর মাধ্যমে প্রকাশ পায়:


১. মূল নীতিগুলোর বাস্তবায়নের অস্পষ্টতা

  • জাতীয়তাবাদ: সংবিধানে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে জোর দেওয়া হয়েছিল, যা বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জনগোষ্ঠীর পরিচয়কে প্রাধান্য দিয়েছিল। তবে, এটি উপজাতি ও অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর পরিচয়কে উপেক্ষা করেছিল। ফলে, পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়।
  • ধর্মনিরপেক্ষতা: ধর্মনিরপেক্ষতাকে মূল নীতি হিসেবে ঘোষণা করা হলেও, এর বাস্তবায়নের জন্য পরিষ্কার নীতিমালা বা কাঠামো ছিল না। ধর্মীয় সংগঠনগুলোর প্রভাব এবং রাজনৈতিক ব্যবহারের কারণে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ প্রায়ই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
  • সমাজতন্ত্র: সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির কথা বলা হলেও, এর বাস্তবায়নের জন্য কার্যকর পরিকল্পনা বা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ছিল না। জাতীয়করণ নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল, কিন্তু অদক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং দুর্নীতির কারণে এটি অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারেনি।
  • গণতন্ত্র: গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কথা বলা হলেও, সংবিধানে প্রধানমন্ত্রী-কেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যা ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করেছিল।


২. ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ

  • সংবিধানে সংসদীয় গণতন্ত্রের কথা বলা হলেও, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা অত্যধিক ছিল। মন্ত্রিসভা প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল, এবং সংসদের ভূমিকা তুলনামূলকভাবে দুর্বল ছিল।
  • স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার উপর পর্যাপ্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়নি, যা কেন্দ্রীয় সরকারের উপর নির্ভরশীলতা বাড়িয়েছিল।


৩. চতুর্থ সংশোধনী এবং একদলীয় শাসন

  • ১৯৭৫ সালের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়, যা একদলীয় শাসনব্যবস্থা (বাকশাল) প্রতিষ্ঠা করে। এটি ১৯৭২ সালের সংবিধানের গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের সাথে সাংঘর্ষিক ছিল। এই সংশোধনী সংবিধানের মূল চেতনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং এটি অনেকের কাছে ১৯৭২ সালের সংবিধানের একটি বড় অসঙ্গতি হিসেবে বিবেচিত হয়।
  • এই সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতি-কেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়, যা সংসদীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তে একনায়কতন্ত্রের পথ প্রশস্ত করে।


৪. মৌলিক অধিকারের সীমাবদ্ধতা

  • সংবিধানে মৌলিক অধিকারের কথা বলা হলেও, এগুলোর প্রয়োগে বিভিন্ন শর্ত আরোপ করা হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, জরুরি অবস্থার সময় মৌলিক অধিকার স্থগিত করার বিধান ছিল, যা ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করেছিল।
  • সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল, যা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক ছিল।


৫. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা

  • সংবিধানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা বলা হলেও, বাস্তবে এটি নির্বাহী বিভাগের প্রভাবের অধীনে ছিল। বিচারপতিদের নিয়োগ ও পদোন্নতিতে সরকারের হস্তক্ষেপ ছিল, যা বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল।


৬. অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার সাথে অসামঞ্জস্য

  • সংবিধানে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির কথা বলা হলেও, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামো এবং সম্পদের সীমাবদ্ধতা এই নীতি বাস্তবায়নের পথে বড় বাধা ছিল।
  • দারিদ্র্য, অশিক্ষা এবং অবকাঠামোগত দুর্বলতার প্রেক্ষাপটে সংবিধানের উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়ন করা কঠিন ছিল।


৭. সংশোধন প্রক্রিয়ার সহজতা

  • সংবিধানে সংশোধন প্রক্রিয়া তুলনামূলকভাবে সহজ ছিল (সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে), যা সংবিধানকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করেছিল। এটি পরবর্তীকালে বিভিন্ন সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের মূল চেতনা পরিবর্তনের কারণ হয়।


প্রশ্নোত্তর


প্রশ্ন ১: ১৯৭২ সালের সংবিধানের মূল নীতিগুলো কী ছিল এবং এগুলোর বাস্তবায়নে কী ধরনের অসঙ্গতি ছিল?

উত্তর:
১৯৭২ সালের সংবিধানের মূল নীতি ছিল জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা। এগুলোর বাস্তবায়নে নিম্নলিখিত অসঙ্গতি ছিল:

  • জাতীয়তাবাদ: বাঙালি জাতীয়তাবাদ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর পরিচয়কে উপেক্ষা করে, যা পার্বত্য চট্টগ্রামে উত্তেজনা সৃষ্টি করে।
  • সমাজতন্ত্র: সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির জন্য কার্যকর পরিকল্পনা ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অভাব ছিল। জাতীয়করণ নীতি অদক্ষ ব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কারণে ব্যর্থ হয়।
  • গণতন্ত্র: প্রধানমন্ত্রী-কেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা এবং সংসদের দুর্বল ভূমিকা গণতন্ত্রের চেতনাকে ক্ষুণ্ণ করে।
  • ধর্মনিরপেক্ষতা: ধর্মনিরপেক্ষতার বাস্তবায়নের জন্য পরিষ্কার নীতিমালার অভাব এবং ধর্মীয় সংগঠনের প্রভাব এই নীতিকে দুর্বল করে।


প্রশ্ন ২: চতুর্থ সংশোধনী কীভাবে ১৯৭২ সালের সংবিধানের মূল চেতনাকে প্রভাবিত করেছিল?

উত্তর:
১৯৭৫ সালের চতুর্থ সংশোধনী ১৯৭২ সালের সংবিধানের গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই সংশোধনীর মাধ্যমে:

  • সংসদীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি-কেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়।
  • একদলীয় শাসনব্যবস্থা (বাকশাল) প্রতিষ্ঠিত হয়, যা বহুদলীয় গণতন্ত্রের পরিপন্থী ছিল।
  • মৌলিক অধিকার এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সীমিত করা হয়।
  • ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়।
    এই সংশোধনী সংবিধানের মূল চেতনাকে পরিবর্তন করে এবং একনায়কতন্ত্রের পথ প্রশস্ত করে।


প্রশ্ন ৩: ১৯৭২ সালের সংবিধানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে কী ধরনের অসঙ্গতি ছিল?

উত্তর:
১৯৭২ সালের সংবিধানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা বলা হলেও, বাস্তবে নিম্নলিখিত অসঙ্গতি ছিল:

  • বিচারপতিদের নিয়োগ, পদোন্নতি এবং পদচ্যুতিতে নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপ ছিল।
  • সরকারের প্রভাবের কারণে বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হতো।
  • জরুরি অবস্থার সময় মৌলিক অধিকার স্থগিত করার বিধান বিচার বিভাগের কার্যকারিতাকে সীমিত করত।
    এসব কারণে বিচার বিভাগ সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে পুরোপুরি মুক্ত ছিল না।


প্রশ্ন ৪: সংবিধানের সংশোধন প্রক্রিয়া কীভাবে এর অসঙ্গতির কারণ হয়েছিল?

উত্তর:
১৯৭২ সালের সংবিধানে সংশোধনের জন্য সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রয়োজন ছিল, যা তুলনামূলকভাবে সহজ প্রক্রিয়া ছিল। এটি নিম্নলিখিত অসঙ্গতির কারণ হয়:

  • সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে সংবিধান সহজেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সংশোধন করা যেত।
  • চতুর্থ সংশোধনীর মতো সংশোধনী সংবিধানের মূল চেতনাকে পরিবর্তন করে।
  • সংশোধন প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ বা গণভোটের বিধান না থাকায় এটি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক ছিল।


১৯৭২ সালের সংবিধান বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনাকে প্রতিফলিত করলেও, এতে কিছু অসঙ্গতি বা দুর্বলতা ছিল। মূল নীতিগুলোর বাস্তবায়নে অস্পষ্টতা, ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অভাব, এবং সংশোধন প্রক্রিয়ার সহজতা এই সংবিধানের প্রধান অসঙ্গতি হিসেবে বিবেচিত হয়। পরবর্তীকালে বিভিন্ন সংশোধনীর মাধ্যমে এই অসঙ্গতিগুলোর কিছু সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছে, তবে কিছু সমস্যা এখনও রাজনৈতিক ও সামাজিক আলোচনার বিষয় হিসেবে রয়ে গেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Table of Contents

Translate »