১৯৭২ সালের বাংলাদেশের সংবিধান বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী দলিল, যা স্বাধীনতার পর দেশের শাসনব্যবস্থার ভিত্তি হিসেবে প্রণীত হয়। এটি ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গৃহীত হয় এবং ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ থেকে কার্যকর হয়। নিচে সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্য, প্রেক্ষাপট এবং গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করা হলো:
প্রেক্ষাপট
- মুক্তিযুদ্ধের ফলাফল: ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। স্বাধীনতার পর একটি নতুন রাষ্ট্রের জন্য শাসনতান্ত্রিক কাঠামো প্রয়োজন হয়, যা জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ প্রতিফলিত করবে।
- সংবিধান প্রণয়ন: ১৯৭২ সালের ১১ এপ্রিল গণপরিষদে সংবিধান প্রণয়নের কাজ শুরু হয়। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ৩৪ সদস্যের একটি কমিটি সংবিধানের খসড়া তৈরি করে। এটি ছিল গণতান্ত্রিক ও জনগণের অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়ার একটি উদাহরণ।
প্রধান বৈশিষ্ট্য
১৯৭২ সালের সংবিধানের মূল বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ:
- মৌলিক নীতি:
- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা: সংবিধানের প্রস্তাবনায় এই চারটি মূলনীতি উল্লেখ করা হয়, যা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতিফলন।
- ধর্মনিরপেক্ষতা সকল ধর্মের প্রতি সমান অধিকার ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করে।
- গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা:
- সংবিধানে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী হন সরকারের প্রধান, এবং রাষ্ট্রপতির ভূমিকা প্রতীকী।
- সংসদকে (জাতীয় সংসদ) সর্বোচ্চ আইন প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
- মৌলিক অধিকার:
- সংবিধানের তৃতীয় ভাগে (অনুচ্ছেদ ২৬-৪৭) নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে, যেমন- বাকস্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, সমতা, আইনের প্রতি সমান সুরক্ষা ইত্যাদি।
- এই অধিকারগুলো সরকারের নির্বিচারে হস্তক্ষেপ থেকে নাগরিকদের সুরক্ষা দেয়।
- নির্বাহী, আইন ও বিচার বিভাগ:
- ক্ষমতার ত্রিবিভাজন নীতি অনুসরণ করা হয়, যদিও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সম্পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
- সুপ্রিম কোর্টকে সংবিধানের রক্ষক হিসেবে গণ্য করা হয়।
- রাষ্ট্রভাষা ও জাতীয় সংস্কৃতি:
- বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় (অনুচ্ছেদ ৩)।
- বাঙালি জাতির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে উৎসাহিত করার কথা বলা হয়।
- অর্থনৈতিক নীতি:
- সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির উপর ভিত্তি করে সংবিধানে সামাজিক ন্যায়বিচার ও সমতার কথা বলা হয়।
- জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণ ও দারিদ্র্য নিরসনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়।
গুরুত্ব
- জাতীয় ঐক্য: সংবিধান বাংলাদেশের জনগণের ঐক্য ও পরিচিতির প্রতীক হিসেবে কাজ করে।
- মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ: এটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়।
- আইনের শাসন: সংবিধান আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও নাগরিক অধিকার সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- গণতান্ত্রিক কাঠামো: এটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করে, যা জনগণের ক্ষমতায়নের জন্য অপরিহার্য।
সমালোচনা ও সংশোধন
- সমালোচনা:
- কিছু সমালোচক মনে করেন, সংবিধানের সমাজতান্ত্রিক নীতি বাস্তবায়নে ব্যর্থতা দেখা গেছে।
- ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টি পরবর্তীতে সংশোধনের মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়, যা বিতর্কের জন্ম দেয়।
- সংশোধন: ১৯৭২ সালের পর সংবিধানে একাধিক সংশোধনী আনা হয়। উল্লেখযোগ্য সংশোধনীগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- ১৯৭৫ সালের চতুর্থ সংশোধনী (একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন)।
- ১৯৮৮ সালের অষ্টম সংশোধনী (ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা)।
- ১৯৯১ সালের দ্বাদশ সংশোধনী (সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা)।
- ২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনী (ধর্মনিরপেক্ষতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, তবে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে রাখা)।
উপসংহার
১৯৭২ সালের সংবিধান বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে একটি মাইলফলক। এটি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটায়। যদিও সময়ের সাথে সংশোধন ও বিতর্ক এসেছে, তবুও এটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। সংবিধানের মূলনীতিগুলো বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা ও সমাজের জন্য দিকনির্দেশনা হিসেবে কাজ করে।