image (2)

১৯৭২ সালের বাংলাদেশের সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী

১৯৭২ সালের বাংলাদেশের সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী (কার্যকর: ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫) বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং বিতর্কিত ঘটনা। এই সংশোধনী সংসদীয় গণতন্ত্র থেকে একদলীয় রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থায় রূপান্তরের পথ প্রশস্ত করে। নিচে এই সংশোধনীর বিস্তারিত আলোচনা, এর প্রেক্ষাপট, প্রধান বিষয়, প্রভাব এবং সাধারণ মানুষের সম্ভাব্য প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো।


চতুর্থ সংশোধনীর প্রেক্ষাপট

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে একটি সংবিধান প্রণয়ন করে, যা ছিল সংসদীয় গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং গণতন্ত্রের উপর ভিত্তি করে। তবে, স্বাধীনতার পরবর্তী বছরগুলোতে দেশ অর্থনৈতিক সংকট, খাদ্যাভাব, দুর্নীতি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার মুখোমুখি হয়। এই পরিস্থিতিতে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার দেশের শাসনব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত নেয়। চতুর্থ সংশোধনী ছিল এই পরিবর্তনের ফলাফল।

সরকারের যুক্তি ছিল যে, বহুদলীয় গণতন্ত্র দেশের অগ্রগতিতে বাধা সৃষ্টি করছে এবং একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করবে। তবে, অনেকে এই সংশোধনীকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী এবং একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখেছেন।


চতুর্থ সংশোধনীর প্রধান বিষয়

চতুর্থ সংশোধনী সংবিধানের মোট ৮৩টি ধারার মধ্যে ৪০টি ধারা সংশোধন করে এবং নতুন কিছু ধারা যুক্ত করে। এর মূল বিষয়গুলো হলো:

  1. রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থা:
    • সংসদীয় ব্যবস্থার পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থা চালু হয়।
    • রাষ্ট্রপতি সরকারের প্রধান নির্বাহী হন এবং প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভা রাষ্ট্রপতির অধীনে কাজ করেন।
    • রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়, যার মধ্যে ছিল সংসদ ভেঙে দেওয়া, মন্ত্রী নিয়োগ ও অপসারণ, এমনকি সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা।
  2. একদলীয় শাসনব্যবস্থা:
    • বহুদলীয় গণতন্ত্র বাতিল করে একদলীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়।
    • ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ (বাকশাল) একমাত্র রাজনৈতিক দল হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
    • অন্যান্য রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হয়, এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়।
  3. মৌলিক নীতির পরিবর্তন:
    • সংবিধানের মৌলিক নীতি (জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা) পুনঃসংজ্ঞায়িত করা হয়।
    • সমাজতন্ত্রের ব্যাখ্যায় জোর দেওয়া হয় শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের উপর।
    • ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞায় কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়, যা পরবর্তীতে বিতর্কের জন্ম দেয়।
  4. সংসদের ক্ষমতা হ্রাস:
    • জাতীয় সংসদের ক্ষমতা সীমিত করা হয়। সংসদ রাষ্ট্রপতির নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়ে।
    • রাষ্ট্রপতি সংসদের অধিবেশন আহ্বান, স্থগিত বা ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা পান।
  5. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংকোচন:
    • সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বিষয়ে বিচারের ক্ষমতা কমানো হয়।
    • রাষ্ট্রপতি বিচারপতিদের নিয়োগ ও অপসারণের ক্ষমতা পান, যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
  6. জরুরি অবস্থার বিধান:
    • রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা ঘোষণার ক্ষমতা পান, যা নাগরিকদের মৌলিক অধিকার স্থগিত করতে পারে।
    • এই বিধান জনগণের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকারের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের পথ প্রশস্ত করে।
  7. সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা:
    • রাষ্ট্রপতি এককভাবে সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা পান, যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পরিপন্থী ছিল।


চতুর্থ সংশোধনীর প্রভাব

  1. গণতন্ত্রের অবসান:
    • বহুদলীয় গণতন্ত্র বাতিল হওয়ায় রাজনৈতিক বিরোধী দলগুলো নিষিদ্ধ হয়, এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে সংকুচিত হয়।
    • একদলীয় শাসনব্যবস্থা জনগণের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে।
  2. ক্ষমতার কেন্দ্রীভূতকরণ:
    • রাষ্ট্রপতির হাতে অতিরিক্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ায় শাসনব্যবস্থা একনায়কতন্ত্রের দিকে ঝুঁকে পড়ে।
    • এটি সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা কমিয়ে দেয়।
  3. অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব:
    • সরকারের দাবি ছিল যে, একদলীয় ব্যবস্থা অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করবে। কিন্তু বাস্তবে অর্থনৈতিক সংকট ও খাদ্যাভাব অব্যাহত থাকে।
    • বাকশালের মাধ্যমে গ্রামীণ পর্যায়ে সমবায় ব্যবস্থা চালুর পরিকল্পনা করা হয়, কিন্তু তা কার্যকর হয়নি।
  4. রাজনৈতিক অস্থিরতা:
    • চতুর্থ সংশোধনী জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অসন্তোষ বাড়িয়ে দেয়।
    • ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে এই শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটে।
  5. দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব:
    • চতুর্থ সংশোধনী বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গণতন্ত্রের প্রতি সংশয় সৃষ্টি করে।
    • পরবর্তী সরকারগুলো এই সংশোধনীর অনেক বিধান বাতিল করে, এবং ১৯৯১ সালের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।


সাধারণ মানুষের সম্ভাব্য প্রশ্ন ও উত্তর

  1. প্রশ্ন: চতুর্থ সংশোধনী কেন প্রয়োজন ছিল?
    • উত্তর: সরকারের মতে, দেশে অর্থনৈতিক সংকট, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বহুদলীয় ব্যবস্থার অপব্যবহারের কারণে একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা প্রয়োজন ছিল। তারা দাবি করে যে, এটি দ্রুত উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা আনবে। তবে, সমালোচকরা বলেন, এটি ছিল ক্ষমতা ধরে রাখার কৌশল।
  2. প্রশ্ন: বাকশাল কী ছিল?
    • উত্তর: বাকশাল (বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ) ছিল চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত একমাত্র রাজনৈতিক দল। এটি শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত হয় এবং দেশের সকল রাজনৈতিক কার্যক্রম এর অধীনে নিয়ন্ত্রিত হতো। এর উদ্দেশ্য ছিল সমাজতান্ত্রিক নীতির ভিত্তিতে দেশ পরিচালনা।
  3. প্রশ্ন: চতুর্থ সংশোধনী কি গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর ছিল?
    • উত্তর: হ্যাঁ, এটি বহুদলীয় গণতন্ত্র বাতিল করে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করে, যা রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকার সীমিত করে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হ্রাস এবং জরুরি অবস্থার বিধান গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী ছিল।
  4. প্রশ্ন: জনগণ কীভাবে এই সংশোধনী গ্রহণ করেছিল?
    • উত্তর: জনগণের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ছিল। সরকার সমর্থকরা এটিকে উন্নয়নের পথ হিসেবে দেখলেও, বিরোধী দল ও সাধারণ জনগণের একটি বড় অংশ এটিকে গণতন্ত্রের উপর আঘাত হিসেবে বিবেচনা করে। এটি রাজনৈতিক অসন্তোষ বাড়িয়ে দেয়।
  5. প্রশ্ন: চতুর্থ সংশোধনীর পর কী হয়েছিল?
    • উত্তর: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর এই শাসনব্যবস্থার পতন ঘটে। পরবর্তী সরকারগুলো বাকশাল নিষিদ্ধ করে এবং সংবিধানে নতুন সংশোধনী এনে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে।
  6. প্রশ্ন: এই সংশোধনী কি সম্পূর্ণ বাতিল হয়েছে?
    • উত্তর: হ্যাঁ, চতুর্থ সংশোধনীর বেশিরভাগ বিধান পরবর্তী সংশোধনী, বিশেষ করে পঞ্চম (১৯৭৯) এবং দ্বাদশ (১৯৯১) সংশোধনীর মাধ্যমে বাতিল বা সংশোধন করা হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত।


বিশ্লেষণ ও সমালোচনা

চতুর্থ সংশোধনী বাংলাদেশের সাংবিধানিক ইতিহাসে একটি বিতর্কিত অধ্যায়। এটি স্বাধীনতার পর প্রথম দশকে দেশের রাজনৈতিক দুর্বলতা এবং শাসনব্যবস্থার পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রতিফলন। সমালোচকরা বলেন, এই সংশোধনী গণতান্ত্রিক আদর্শ থেকে বিচ্যুতি ঘটিয়েছে এবং শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের প্রতি জনগণের আস্থা কমিয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে, সমর্থকরা যুক্তি দেন যে, তৎকালীন সংকটময় পরিস্থিতিতে শক্তিশালী নেতৃত্বের প্রয়োজন ছিল।

তবে, ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই সংশোধনী বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়িয়ে দেয় এবং পরবর্তী সামরিক শাসনের পথ প্রশস্ত করে। এটি আমাদের শিক্ষা দেয় যে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা ও জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতা অর্জন কঠিন।


চতুর্থ সংশোধনী ছিল বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থায় একটি পরীক্ষামূলক পদক্ষেপ, যা গণতন্ত্রের পরিবর্তে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিল। এটি স্বল্পমেয়াদে সরকারের ক্ষমতা বাড়ালেও, দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Table of Contents

Translate »